কক্সবাজারের চকরিয়ায় দুই নারী একাধিকবার শ্লীলতাহানির শিকার হওয়ার পর সাহস করে আদালতের দ্বারস্থ হলেও সেই উদ্যোগ যেন হয়ে দাঁড়ায় নতুন নিপীড়নের কারণ। আদালতে মামলা করার একদিন পরই অভিযুক্ত যুবক থানায় ‘হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগ এনে পাল্টা মামলা করেন। আর সেই মামলা গ্রহণ করে, কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই, চকরিয়া থানা-পুলিশ উল্টো দুই নারী ভুক্তভোগীকেই আটক করে- যাদের একজনের বয়স ২৭, অপরজন শিশুসন্তানসহ বাসায় থাকেন।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া ও পুলিশি আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযোগ উঠেছে, আসামিপক্ষের প্রভাব ও টাকার বিনিময়ে থানার ভূমিকা ভিন্নখাতে মোড় নেয়। বাদীপক্ষ বলছে, ভুক্তভোগীদের ১০ ঘণ্টা থানায় আটকে রেখে জোরপূর্বক আপসনামায় সই করিয়ে নেওয়া হয়।
২৩ জুন চকরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ৮ জুন রাত ৮টার দিকে শাহরিয়ার রোস্তম মানিক নামের এক যুবক একটি ভাড়া বাসায় ঢুকে এক নারীকে কুপ্রস্তাব দেন এবং শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। প্রতিবাদ করলে ওই নারীকে গলা চেপে ধরেন ও তাঁর সহবাসী আরেক নারীকে (মামলার বাদী) কামড়ে আঙুলের মাংস ছিঁড়ে দেন। ঘটনার পর মানিক ফোনে হুমকি দিয়ে মামলা না করতে বলেন।
আদালতে মামলা হওয়ার পরদিন ২৫ জুন শাহরিয়ার মানিক চকরিয়া থানায় গিয়ে ‘হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগে পাল্টা মামলা করেন। থানা কর্তৃপক্ষ সেই মামলা গ্রহণ করে এবং বাদীসহ দুই নারীকে অভিযুক্ত করে আটক করে। অথচ ভুক্তভোগীদের দাবি, তাদের মামলা থানায় নিতে রাজি হয়নি পুলিশ। বাধ্য হয়ে তারা আদালতের শরণাপন্ন হন।
২৬ জুন বিকেলে থানার এসআই শফিকুল ইসলাম রাজা ওসির নির্দেশে দুই নারীকে থানায় নিয়ে যান।
বাদীর অভিযোগ অনুযায়ী, থানায় গিয়ে জানতে পারেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এরপর থানার হাজতে দুই ঘণ্টা ও আরও আট ঘণ্টা থানার ভেতরে আটকে রাখা হয়। রাত ৯টার দিকে ওসির সঙ্গে দেখা হলে তারা আদালতে দায়ের করা মামলার নথিপত্র দেখান। তখন থানার কর্মকর্তারা ‘টেনশনে পড়ে যান’ এবং সমঝোতার উদ্যোগ নেন।
অভিযোগ রয়েছে, রাত সোয়া ২টার দিকে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে ৬০ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ উল্লেখ করে জোর করে সই করিয়ে নেওয়া হয়। তখন উপস্থিত ছিলেন একজন আইনজীবীও।
বাদী জানান, ‘একই ঘটনা, একই সময়, একই স্থান। অথচ আমাদের মামলাটি থানা নেয়নি, বরং অভিযুক্তের পক্ষে মামলা নিয়েছে। এটা সরাসরি পক্ষপাত।’ তিনি আরও বলেন, একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জেনেছেন, তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নিতে ২ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।
চকরিয়া থানার এসআই শফিকুল ইসলাম রাজা বলেন, ‘সরেজমিন তদন্ত করেছি। আসামি তখন বাসায় ছিল না। পরে দুই পক্ষ আপসে রাজি হলে একজন আইনজীবীর উপস্থিতিতে সমঝোতা হয়।’
তবে বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন চকরিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) মো. মঈন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আসামিকে ধরে থানায় এনে আপস করানোর সুযোগ নেই। সেটি আদালতের এখতিয়ার।’
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের প্রশ্ন, একজন নারী আদালতে শ্লীলতাহানির অভিযোগ দিলে তাকে সংরক্ষণ না করে কেন উল্টো তাকে থানায় আটকে রেখে আপস করানো হলো? আর সেই আপস কি আদৌ আইনসম্মত?
তাদের মতে, এই ঘটনায় স্পষ্ট, দেশের আইনি কাঠামোর মাঝে অনেক সময়ই ভুক্তভোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একজন নারী সাহস করে আদালতে মামলা করেও যখন থানায় গিয়ে অপরাধীর সঙ্গে আপসে বাধ্য হন, তখন সেটি শুধু বিচারের ব্যর্থতা নয়- মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুই পক্ষ আত্মীয়। একটি মারামারির ঘটনায় নারীরা আদালতে মামলা করেছে, আর ছেলেটি থানায় মামলা করেছে। পরে উভয় পক্ষ থানায় বসে আপসে পৌঁছেছে। এবং মামলা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেজন্য আসামিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। যিনি আপনাদের তথ্য দিচ্ছেন, তিনি বিষয়টি বাড়িয়ে বলছেন।’
Leave a Reply